ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা
-আতিক রহমান
অনেক আগের ঘটনা, বৃটিশ আমলের প্রথম দিকে অথবা মাঝামাঝি। মুসলমানদের ধর্মীয় অস্তিত্বের খুব নাজুক অবস্থা। গ্রামে হিন্দুদের পুজাপার্বনে মুসলমানরাই অনেকে ঢাকঢোল বাজায়, দেবী বিসর্জন দেয়, কালেমা জানে না, নামাজ রোজার সাথে সম্পর্ক নেই নিজের নবীরও নাম জানে না। মসজিদের সংখ্যাও খুব কম। যেসব মসজিদ ছিল, দুই চারজন পরিচিত বৃদ্ধ লোক নিয়ে নামাজ পড়ান ইমাম সাহেব, মিলাদ পড়ান বাড়িতে বাড়িতে।
ঈদেমিলাদুন্নবি,শবে বরাত এ হৈচৈ করা বা সিন্নি বিতরনের সময় একটু আধটু লোকজনের দেখা মেলে।
মুসলমানদের ছেলেদের নাম রাখা হয় গোপাল, পটল, শীতল ইত্যাদি মেয়েদের নাম রাখা হয় পেঁচি, খেঁদি,শান্তি ইত্যাদি মানে নাম শুনে বোঝার উপায় নেই হিন্দু না মুসলমান। মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব গুলি এমনকি ঈদের দিনও ছুটি ছিল না, উইলিয়াম হান্টারের দি ইন্ডিয়ান মুসলিম পড়লে কিছুটা জানা যায়।
এক মৌলানা সাহেবকে উত্তর বঙ্গের কয়েকটি গ্রামে ধর্ম প্রচারের জন্য আদেশদেওয়া হলো, সম্ভবত হাজী শরীতুল্লাহ বা তার উত্তর পুরুষ কোন বুজুর্গের পক্ষ থেকেই। মৌলানার বাড়িও এদিকেই কোন এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে।
তিন-চার গ্রামে কোন মসজিদ নেই, কিন্তু মুসলমান জনসংখ্যায় কম নয় সেখানে। তিনি একটা কেন্দ্রীয় অবস্থান দেখে মসজিদ বানানোর পরিকল্পনা করলেন।সবাই সোৎসাহে সমর্থন করলো।বাঁশের বেড়া আর ছোনের( এক ধরনের ঘাস জাতীয় গাছ, শুকিয়ে ঘরের চাল বা ছাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হতো, এখন প্রায় নেই হয়ে গেছে, টিন আর ইট সিমেন্টের ব্যবহারে।) ছাঁদ দিয়ে মসজিদ তো তৈরি হলো,মাটির মেঝে লেপে দেবে গোবর দিয়ে,গোবর নাপাক জিনিস, মৌলানা সাহেব মানা করলেন শেষে ধানের তুষ দিয়ে লেপার কাজ সারা হলো।
নামাজের কিছু নিয়ম কানুন, সুরা কেরাত শিখিয়ে মৌলানা সাহেব ইমামতির জন্য সামনে দাড়ালেন পেছনে লোকজন কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়াল। নামাজ শুরু হয়েছে ইমাম কেরাত পড়া শুরু করেছেন, স্থানীয় এক মাতব্বরের মনে হলো ইমাম সাহেব সামনে একা দাঁড়াবেন কেন তার মত গন্যমান্য এক-আধজন তার সাথে দাঁড়ানো দরকার।
সে ইমামের বাম পাশে গিয়ে তার বরাবর দাড়িয়ে পরল। ইমাম সাহেব দেখলেন বিপদ ইমাম দুইজন হয়ে গেছে নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে, ডানে দাঁড়ালে না হয় একটু পেছনে সরিয়ে দেওয়া যেত এতো দাড়িয়েছে বামে, নামাজের মধ্যে কিছু বলতেও পারছেন না,নামাজ ভেঙে যাবে, তিনি বাম কনুই দিয়ে গুতা মারলেন সেই মাতব্বরকে মানে সরে যাও।
নামাজের আগে ইমাম সাহেব বলেছিলেন তিনি যেভাবে নামাজ পড়বেন মুক্তাদি বা লোকজন যেন তাকে হুবহু অনুসরণ করে। এখন ইমাম সাহেবের কনুই এর গুতাকেও তারা নামাজের অঙ্গ মনে করে নিজেরা পাশের জনের প্রতি কনুই ব্যাবহার করতে লাগলো। কনুই এর গুতা থেকে বাঁচতে সরতে লাগলো পাশের জন, এক সময়ে বাম পাশের বাঁশের বেড়ায় গিয়ে পৌঁছুল তারা,বেড়া ভেঙে পড়ে গেল।
বাধ্য হয়ে মৌলানা সাহেব নামাজ ছেড়ে দিলেন। সবাইকে আবার বুঝিয়ে শুনিয়ে নামাজ পড়লেন। তখন ছিল গোলাভরা ধান নদী ভরা মাছের যুগ। মৌলানা সাহেবকে গ্রামবাসী আপ্যায়নে ত্রুটি করলো না। কয়েকদিন থেকে তিনি রওনা হলেন তার পীর সাহেবের খানকার দিকে। সামনে রমজান মাসসহ তিনি কয়েকমাস সেখানেই থাকবেন। গ্রাম পেরিয়ে এসে তার মনে হলো আরে তিনি ইসলামের একটা ভিত্তি, রোজা সম্বন্ধে তো গ্রামবাসীকে শিক্ষা দেন নি, আবার ফিরে যাবেন এতদূর এসে, কি করেন। কয়েকজন তাকে এগিয়ে দিতে এসেছিল তার মধ্যে সেই মাতব্বরটাও ছিল যে ইমামের সাথে সামনে নামাজে দাড়িয়ে ছিল, সে বেচারা পেশাপ করতে বসে দেরী করে ফেলেছিল যেতে, তাকে ডেকে নিয়ে এলেন।
পথের মধ্যেই রোজা কি তার গুরুত্ব, রোজা কবে আসবে, কোনসময় আসবে, কিভাবে রাখতে হবে বুঝানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু গ্রাম্য লোক তো মাথায় কিছুই ঢোকে না। শেষে মাতব্বর বুঝল রোজা আসবে অমুক দিনে, ভোর রাতে রোজা রাখতে হবে, অন্য যা কিছু মৌলানা সাহেব বলেছিলেন সব মাথা থেকে ধুয়ে মুছে গেছে।
সে গ্রামবাসীকে যেটুকু সে বুঝেছিল মৌলানা সাহেবের কাছে থেকে ততটুকুই বুঝালো। গ্রামবাসীরা সহজ সরল এবং তাদের মধ্যে মানার অভ্যাস ছিল। এখন রোজা কি জিনিস গ্রামবাসীদের ধারনা নেই কিন্তু রোজা আসবে এবং রাখতে হবে।
অনেক আলোচনা করে লোকজন বুঝল যে কেউ বা কিছু আসবে তার নাম রোজা এবং আসবে অমুক দিন ভোর রাতে।কোন দিক দিয়ে আসবে, নিশ্চয় মৌলানা সাহেব যে দিক দিয়ে এসেছেন সেদিক দিয়েই আসবে, অন্য দিক দিয়ে আসার সম্ভাবনা কম।
সেই তারিখ রাত থাকতেই গ্রামের সব সমর্থ পুরুষ মানুষ গ্রামের সীমানায় পৌঁছে গেল। কেউ বা গাছের ওপরে কেউবা রাস্তায়, কিছু লোক ক্ষেতের ওপরেও বসে অপেক্ষা করছে রোজার জন্য। ভোর হয়ে এলো আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। সেসময় গ্রাম-গঞ্জের আশেপাশে ঘন জঙ্গল ছিল, সেখানে হরিন,শুকর,চিতাবাঘ, মেছোবাঘ ছাড়াও অনেক প্রাণীর দেখা মিলতো, বিরল হলেও দুস্প্রাপ্য ছিলো না এই প্রাণীগুলো ।
এক হরিণ তার বাচ্চা, (বাচ্চাটাও বড় প্রায় পূর্ণ বয়স্ক),নিয়ে গ্রামের সীমানার পাশে ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছিল, পিপাসা পাওয়ায় খাল থেকে পানি খাচ্ছিল।এসময় গ্রামবাসীর নজরে পড়ে যায়।অন্য কোন কিছুর দেখা না পেয়ে তাদের ধারনা হয় এটাই রোজা, তবে রোজা বাচ্চা সহকারে আসবে তা তো মৌলানা সাহেব বলেননি,হয়তো সময় পাননি বা ভুলে গেছেন বলতে।
সবাই হৈহৈ করে উঠল, ঘিরে ফেললো, হরিণ দুটিকে। হরিন তো এক লাফে অনেকদূর যায়,গ্রামবাসী হয়রান হয়ে গেল একজনের হলংগার ( একধরনের বাঁশের বর্শা) আঘাতে মা হরিণটা প্রাণ হারালো।বাচ্চাটা পালাতে গিয়ে আরেকলোকের কাঁড়ালের ( সামনের দিকে বাঁকা বাঁশের দন্ড,গ্রামে সাধারণত খড় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় ) আঘাতে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করল।
গ্রামবাসীরা বেশ বিব্রত হলো, মৌলানা সাহেব, রোজা রাখতে বলেছিল দুর্ভাগ্যক্রমে তারা রোজা রাখতে না পেরে শেষ করে দিল, মৌলানা সাহেব আগেই বলতে পারতেন রোজা কি জিনিস। কেউ কেউ বেশী বুদ্ধিমান তাদের মাথায় ঢুকলো না যে এরকম রোজা রাখার ধর্মীয় তাৎপর্যই বা কি।
মৌলানা সাহেব রোজার মাস, রোজার ঈদ এবং কোরবানির ঈদ শেষ করে আবার এই পথে এলেন এবং সেই গ্রামেই ফিরলেন, লোকজন খুব সমাদর করেই তাকে গ্রহণ করল। সেই মসজিদে নামাজ পড়ালেন গ্রামবাসীদের নিয়ে এরপর খাওয়াদাওয়া শেষে এক মাতব্বরের বাড়িতে
লোকজনের সাথে কথা বলছেন।
রোজা এসেছিল, আপনারা কি রোজা রেখেছিলেন।
সবাই উশখুশ করছে,কেউ কিছু বলছে না শেষে একজন বলে উঠল।
হুজুর রাখার চেষ্টা করেছিলাম পারি নাই।
প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন গ্রামবাসীর দিকে।
অনেক চেষ্টা করেছিলাম রাখতে পারি নাই হুজুর শেষে হলংগার আঘাতে রোজা মরেই গেলো। আরেকজন বললো
রোজা মরে গেল মৌলানার তো আক্কেলগুড়ুম, বলে কি, মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এল আচমকা
নাউজুবিল্লাহ।
গ্রামবাসী শুনল একটা অব্যয় সহ ‘ও’ নাউজুবিল্লাহ, এবং ভাবলো হয়তো হরিণের বা রোজার বাচ্চাটার কথা বলছে মৌলানা।
হুজুর নাউজুবিল্লাহটাও মরে গেছে। মাতব্বর বলল সসংকোচে।
Add Comment