হ্যালোডেস্ক
কোনো বাধাই এখন আর ওদের দমিয়ে রাখতে পারে না। ওরা দুরন্ত-দুর্বার। সব বাধা পেরিয়ে ওরা এগিয়ে চলেছে সম্মুখপানে। নাম ওদের ‘সাইকেল বালিকা’। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা চরটেকী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী ওরা। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সব ছাত্রীই বাড়ি থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে তাদের প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করে থাকে। সে কারণে সবাই তাদের সাইকেল বালিকা নামেই ডাকে। কিন্তু শুরুতে চলার পথটা তাদের এতটা মসৃণ ছিল না। নানাজনের নানা কটু কথা, বাধা ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে তাদের। পাকুন্দিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে চরটেকী গ্রামে বিদ্যালয়টি অবস্থিত।
১৯৯৩ সালে এলাকার কয়েকজন শিক্ষানুরাগী এলাকায় নারী শিক্ষার প্রসারে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মিজানুর রহমান জানান, শুরুতে বেঞ্চ, টেবিল না থাকায় মেঝেতে চট বিছিয়ে পড়তে হয়েছে মেয়েদের। শিক্ষকদেরও বসার তেমন চেয়ার ছিল না। শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়টি আজ গৌরবের এ অবস্থানে এসেছে। সরকারি বরাদ্দ ছাড়াই বিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে অর্ধপাকা দালান হয়েছে, নির্মাণ করা হয়েছে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ। বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে চার শতাধিক ছাত্রী রয়েছে।
২০১১ সালে বিদ্যালয়ের সঙ্গে কলেজের কার্যক্রমও শুরু করা হয়। কলেজ পর্যায়ে রয়েছে ৫০ জনেরও বেশি ছাত্রী। আশপাশের শিক্ষার্থী ছাড়া দূরের সব শিক্ষার্থীই বাইসাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে থাকে। প্রধান শিক্ষক আমিনুল হক জানান, বিদ্যালয়টিতে ছাত্রীদের কোনো বেতন দিতে হয় না। শুধু বছরে একবার সেশন ফি ও পরীক্ষার ফি দিতে হয়। তাদের বাইরে প্রাইভেটও পড়তে হয় না। ১৯৯৩ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় সুখিয়া ইউনিয়নের জয়বিষ্ণ গ্রামের কেরামত আলীর মেয়ে সামিয়া ফেরদৌসী কলি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। সেই প্রথম বাড়ি থেকে বাইসাইকেলে করে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া শুরু করে। তাকে দেখে আস্তে আস্তে আরও অনেক ছাত্রী বাইসাইকেল চালনা শিখে বিদ্যালয়ে যাতায়াত শুরু করে। তিনি আরও জানান, শুরুতে বাই সাইকেলে করে মেয়েরা বিদ্যালয়ে আসা যাওয়াটা অনেকেই সহজভাবে মেনে নেননি। বাঁকা চোখে দেখতেন কেউ কেউ। আর রাস্তাঘাটে বখাটেপনা তো ছিলই। তবে শিক্ষক, অভিভাবক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সব বাধাই একসময় কেটে যায়। প্রথম বাইসাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে আসা সামিয়া ফেরদৌসী কলি বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা। শুধু তাই নয়, এ বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে পাঁচজন ছাত্রী চিকিৎসক হয়েছেন। ১০ জন ছাত্রী বর্তমানে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করছেন। এ বিদ্যালয় থেকে বের হয়ে দেশের প্রায় সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছেন অনেক ছাত্রী। গত বছর এ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় ৬৭ জন পাস করেছে। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে আটজন। বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী আয়শা জান্নাত মিম জানায়, একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই সে বাইসাইকেল চালানো শিখে। তার পিতা সৌদি প্রবাসী শহীদুল হক চেঙ্গিস তাকে সাইকেল কিনে দেন এবং সাইকেল চালানোয় উৎসাহ দেন। প্রথমে সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে পড়ে গিয়ে পায়ে প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছিল। এরপরও সাইকেল চালাতে তার উৎসাহ কমেনি। চর কাওনা মধ্যপাড়া গ্রামে তার বাড়ি। এখন প্রতিদিনই বাড়ি থেকে বাইসাইকেলে করে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করে সে। রাস্তা কাঁচা থাকায় বর্ষাকালে সাইকেলে যাতায়াত করতে অনেক সমস্যা হয়। কাদা মাটিতে চাকা আটকে গিয়ে অনেক সময় পড়ে গিয়ে পোশাক নষ্ট হয়ে যায়।
দশম শ্রেণির ছাত্রী আফছানা জাহান তামান্না জানায়, চর তেরটেকিয়া গ্রাম থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সাইকেলে করে সে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী আফিয়া হুমায়রা, দশম শ্রেণির ছাত্রী আনিকা তাবাসসুম, শান্তা ইসলাম মৌমিসহ আরও অনেক ছাত্রী জানায়, তারা সাইকেল চালাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকে। এতে সময়ের অপচয় কম হয় এবং শারীরিক ব্যায়ামেরও কাজ হয়। অভিভাবক ও শিক্ষকরা সাইকেল চালাতে ছাত্রীদের উৎসাহিত করেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, এখানকার ছাত্রীরা লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা এবং অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও সমান পারদর্শী। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তারা শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়ে থাকে। ছাত্রীরা বাইসাইকেলে যাতায়াত করায় বিদ্যালয়টি আলাদা বৈশিষ্ট্যে পরিচিতি পেয়েছে। এজন্য তারা সবাই গর্ববোধ করেন।
তথ্যসূত্র: বিডি প্রতিদিন
Add Comment